নাস্তিক অর্থ কী? নাস্তিক কে?
নাস্তিক শব্দটি মূলত সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর গঠন বিশ্লেষণ করলে পাই:
- ন = নঞর্থক, না, অনুপস্থিতি।
- অস্তি = অস্তিত্ব, বিদ্যমানতা।
- ইক = বিশেষ্য বা মতবাদ নির্দেশক।
এই সংমিশ্রণে "নাস্তিক" শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় "যার অস্তিত্ব নেই" বা "যিনি অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না"। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে, বিশেষ করে বৈদিক সমাজে, যারা বেদ এবং সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তিগুলো মানত না, তাদের নাস্তিক বলা হতো। এই সংজ্ঞা অনুসারে চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মকেও একসময় নাস্তিক্যবাদী ধারা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
নাস্তিক্যবাদ ও তার মূল দর্শন
নাস্তিক্যবাদ (Atheism) একটি দার্শনিক অবস্থান যা ঈশ্বর বা কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। এটি কোনো একক মতবাদ নয়; বরং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সম্মিলন। সাধারণভাবে, নাস্তিকতাকে দুইভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়:
- নরম নাস্তিকতা (Weak Atheism): এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই, তবে প্রমাণ পেলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এটি একধরনের সংশয়বাদী নাস্তিকতা।
- কঠোর নাস্তিকতা (Strong Atheism): এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং বলা হয় যে ঈশ্বরের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
নাস্তিক্যবাদ মূলত যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞাননির্ভর চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাসকে সন্দেহের চোখে দেখা হয় এবং তার যৌক্তিকতা বা প্রমাণ খোঁজা হয়।
নাস্তিকতা বনাম সংশয়বাদ
অনেকে নাস্তিকতা ও সংশয়বাদকে এক করে ফেলে, তবে এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। সংশয়বাদীরা নিশ্চিত নন যে ঈশ্বর আছেন কিনা, কারণ এর পক্ষে বা বিপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তারা ঈশ্বরের ধারণাকে খোলামন নিয়ে বিচার করেন। অপরদিকে, নাস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে সরাসরি অবিশ্বাস পোষণ করেন।
নাস্তিক্যবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
নাস্তিকতার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন গ্রীক, রোমান এবং ভারতীয় দর্শনে নাস্তিকতার ধারণা বিদ্যমান ছিল।
- চার্বাক দর্শন (ভারত, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০): চার্বাকগণ মনে করতেন যে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানই সত্য। তারা আত্মা, পরকাল বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না।
- সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল: গ্রীক দার্শনিকরা ঈশ্বরের প্রচলিত ধারণার সমালোচনা করেছিলেন, যদিও তারা একপ্রকার সর্বজ্ঞ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন।
- রোমান দার্শন: লুক্রেতিয়াস এবং এপিকুরাস প্রকৃতিবাদী চিন্তার প্রবর্তক ছিলেন, যারা মনে করতেন যে মহাবিশ্বের কার্যকারণ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।
- ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ ও যুক্তিবাদী আন্দোলন: ১৭-১৮ শতকে দার্শনিক ডেভিড হিউম, ডেনিস ডিডরো, ভলতেয়ার এবং পরে নিৎসে, রাশেল, হকিং প্রমুখ নাস্তিকতা ও যুক্তিবাদকে নতুন মাত্রা দেন।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাস্তিকতা
আধুনিক বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতে পারেনি।
- বিগ ব্যাং তত্ত্ব: মহাবিশ্বের সৃষ্টি একটি মহাবিস্ফোরণের ফলে হয়েছে, যা কোনো সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পিত সৃষ্টি নয়।
- ডারউইনের বিবর্তনবাদ: এটি দেখায় কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং অভিযোজনের মাধ্যমে জীবের উদ্ভব হয়েছে, যা ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে।
- নিউরোসায়েন্স ও মনোবিজ্ঞান: মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস মূলত মস্তিষ্কের কার্যকলাপের একটি অংশ, যা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ধর্মীয় ঈশ্বরের ধারণার সমালোচনা
নাস্তিকতা সাধারণত ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঈশ্বরের ধারণাগুলোর অসঙ্গতি তুলে ধরে।
- ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলে পৃথিবীতে দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ কেন?
- কেন ঈশ্বর বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত?
- কেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে স্পষ্ট ও পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ নেই?
- ধর্মীয় নৈতিকতা কি প্রকৃতপক্ষে মানবিক নৈতিকতার চেয়ে উন্নত?
নাস্তিকতা ও সমাজ
নাস্তিকদের প্রতি বিভিন্ন সমাজের মনোভাব ভিন্ন।
- অনেক দেশে নাস্তিকতা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে (যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ফ্রান্স, জাপান)।
- কিছু দেশে নাস্তিকতা প্রকাশ করলে সামাজিক ও আইনি শাস্তির মুখে পড়তে হয় (যেমন সৌদি আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ)।
- নাস্তিক্যবাদী সমাজগুলো সাধারণত বিজ্ঞান, শিক্ষা ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে উন্নততর বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
উপসংহার
নাস্তিকতা কোনো ধর্ম নয়, বরং এটি একটি যুক্তিবাদী অবস্থান। এটি ঈশ্বর বা অলৌকিক সত্তার অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভিত্তিতে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। মানবসভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে নাস্তিকতার ধারণা আরো পরিপক্ব ও বিশ্লেষণধর্মী হয়েছে। নাস্তিক হওয়া মানে কেবল ঈশ্বরে অবিশ্বাস নয়, বরং এটি মুক্ত চিন্তা, যুক্তিবাদ এবং প্রমাণ-ভিত্তিক বাস্তবতার অনুসন্ধান।