Bangladesh Atheism
21 Feb 2025 (3 weeks ago)

বিগ ব্যাং তত্ত্বের বাস্তব প্রমাণ


Listen to this article

মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশ নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরন্তন। আমরা কোথা থেকে এসেছি? মহাবিশ্বের সূচনা কীভাবে হয়েছিল? এটি কি চিরকাল ছিল, নাকি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা বহু শতাব্দী ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা আজ যা জানি, তা হলো মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট সূচনা রয়েছে, এবং এটি একটি মহাবিশ্ব-ব্যাপী বিস্ফোরণ বা প্রসারণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্বকেই আমরা “বিগ ব্যাং তত্ত্ব” নামে চিনি।

বিগ ব্যাং তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্ব একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ঘন, এবং অতি উত্তপ্ত বিন্দু থেকে প্রসারিত হতে শুরু করে। এটি কোনো সাধারণ বিস্ফোরণ ছিল না; বরং এটি ছিল স্থান ও সময়ের সৃষ্টি এবং পদার্থ ও শক্তির প্রাথমিক বিকাশ। শুরুতে মহাবিশ্ব ছিল অতি উত্তপ্ত এবং ঘন, যেখানে প্রচণ্ড শক্তি ও তাপমাত্রার কারণে কোনো সাধারণ পদার্থ টিকে থাকতে পারত না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি প্রসারিত হতে থাকে, ঠান্ডা হতে থাকে এবং বিভিন্ন মৌলিক কণা, পরমাণু, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি গঠিত হয়।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে এই তত্ত্বের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বিগ ব্যাং তত্ত্রের পক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রয়েছে, যেমন—

  1. মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণ (Expanding Universe)
  2. কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (Cosmic Microwave Background – CMB)
  3. হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত (Abundance of Light Elements)
  4. গ্যালাক্সির বিবর্তন এবং মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামো (Galaxy Formation and Large-Scale Structure)
  5. মহাবিশ্বের তাপমাত্রার সমসাময়িকতা (Uniformity of Cosmic Temperature)

এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বিগ ব্যাং তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখন আমরা এসব প্রমাণের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব।


Contents

মহাবিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রসারণ

বিগ ব্যাং তত্ত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো মহাবিশ্বের ক্রমাগত প্রসারণ। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছে, এবং এর বিভিন্ন গ্যালাক্সি একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই ধারণা প্রথমে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল (Edwin Hubble) ১৯২৯ সালে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন।

হাবলের আবিষ্কার: লাল স্থানচ্যুতি (Redshift) ও প্রসারণ

এডউইন হাবল আমাদের মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, গ্যালাক্সিগুলোর আলোতে এক ধরণের পরিবর্তন ঘটছে। যখন কোনো উৎস আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তখন এর আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দীর্ঘ হয়, এবং এটি লাল রঙের দিকে সরতে থাকে। এই ঘটনাকে বলা হয় লাল স্থানচ্যুতি (Redshift)

বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন যে, যদি কোনো গ্যালাক্সির আলো লাল দিকে সরতে থাকে, তাহলে সেটি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে হাবল সিদ্ধান্ত নেন যে, মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে, কারণ সব গ্যালাক্সি একে অপর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

হাবল-লেমেত্রের সূত্র ও মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি

হাবল তাঁর আবিষ্কারের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তৈরি করেন, যা হাবল-লেমেত্রের সূত্র নামে পরিচিত। এই সূত্র অনুযায়ী,


v = H0 × d

এখানে,

  • v হলো গ্যালাক্সির দূরত্ববর্ধনের গতি (recession velocity),
  • H0 হলো হাবল ধ্রুবক (Hubble’s Constant),
  • d হলো গ্যালাক্সির দূরত্ব।

এই সূত্র দেখায় যে, কোনো গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত, এটি তত বেশি গতিতে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের প্রসারণ এক ধরনের গাণিতিক নিয়ম অনুসরণ করছে।

প্রসারণ থেকে বিগ ব্যাং-এর ধারণা

যদি আমরা সময়কে বিপরীত দিকে নিয়ে যাই, তাহলে দেখা যাবে যে, সমস্ত গ্যালাক্সি একসময় এক বিন্দুতে মিলিত হবে। এর অর্থ, মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট সূচনা ছিল, এবং এটি একটি বিন্দু থেকে প্রসারিত হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণই বিগ ব্যাং তত্ত্বকে শক্তিশালীভাবে সমর্থন করে।

%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%82-%e0%a6%a4%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ac-%e0%a6%aa%e0%a7%8d

কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMB) – মহাবিশ্বের আদিম প্রতিচ্ছবি

বিগ ব্যাং তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রমাণ হলো কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (Cosmic Microwave Background – CMB)। এটি এমন এক প্রাচীন বিকিরণ, যা বিগ ব্যাং-এর কয়েক লাখ বছর পরেও মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিল এবং এখনো আমরা এটি পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

CMB কীভাবে আবিষ্কৃত হলো?

১৯৬৫ সালে বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস (Arno Penzias) এবং রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) একটি অদ্ভুত রেডিয়ো সংকেত শনাক্ত করেন। তাঁরা নিউ জার্সিতে একটি বিশাল অ্যান্টেনা ব্যবহার করছিলেন এবং দেখলেন যে, তারা যেকোনো দিকে অ্যান্টেনাটি ঘুরিয়ে দিলেও একটি নির্দিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড সংকেত পাচ্ছেন। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন এটি কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ বা পৃথিবীর কাছাকাছি কোনো উৎস থেকে আসছে, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, এটি আসলে মহাবিশ্বের আদিম বিকিরণ।

এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক বিপ্লব ঘটায়, কারণ এটি বিগ ব্যাং তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল। পেনজিয়াস ও উইলসন এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

CMB কীভাবে তৈরি হলো?

বিগ ব্যাং-এর প্রথম মুহূর্তগুলোতে মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত ও ঘন। সেই সময় পদার্থ মূলত ছিল প্লাজমার আকারে, যেখানে ইলেকট্রন ও প্রোটন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল এবং আলো (ফোটন) এই প্লাজমার কারণে অবাধে চলাচল করতে পারছিল না।

তবে বিগ ব্যাং-এর প্রায় ৩৮০,০০০ বছর পর, মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হয়ে ঠান্ডা হতে থাকে, তখন প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলিত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াকে “recombination” বলা হয়।

এই সময় থেকে আলোর কণা (ফোটন) প্রথমবারের মতো বাধাহীনভাবে চলাচল করতে পারে। এই মুক্ত হয়ে যাওয়া আলোই হলো কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMB), যা আমরা আজও মহাবিশ্বের সর্বত্র অনুভব করতে পারি।

CMB-এর বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব

১. মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গদৈর্ঘ্য:
CMB বিকিরণ এখন মাইক্রোওয়েভ অঞ্চলে রয়েছে, কারণ মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার ফলে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়ে গেছে।

  1. সমগ্র মহাবিশ্বে একরকমভাবে বিস্তৃত:
    এটি মহাবিশ্বের যেকোনো দিকে তাকালেই পাওয়া যায়, এবং প্রায় সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। এটি প্রমাণ করে যে মহাবিশ্বের সূচনা একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে হয়েছে।
  2. তাপমাত্রা:
    CMB-এর বর্তমান গড় তাপমাত্রা ২.৭৩ কেলভিন বা প্রায় -২৭০°C। যদিও এটি প্রায় সমান, তবে সূক্ষ্ম মাত্রার অমসৃণতা (anisotropies) রয়েছে, যা মহাবিশ্বের প্রথম দিকের কাঠামো তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

CMB ও বিগ ব্যাং-এর শক্তিশালী প্রমাণ

CMB বিকিরণের বিশ্লেষণ আমাদের বলে দেয় যে, মহাবিশ্বের প্রথমদিকের অবস্থা কেমন ছিল এবং কীভাবে গ্যালাক্সি ও মহাকর্ষীয় কাঠামো তৈরি হয়েছিল। এটি মহাবিশ্বের প্রাথমিক ঘনত্ব, গঠন, এবং উপাদানের অনুপাত সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়

NASA-এর COBE (Cosmic Background Explorer), WMAP (Wilkinson Microwave Anisotropy Probe), এবং Planck স্যাটেলাইট CMB-এর চমৎকার মানচিত্র তৈরি করেছে, যা বিগ ব্যাং তত্ত্বকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।


হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত – বিগ ব্যাং-এর রাসায়নিক চিহ্ন

বিজ্ঞানীরা যখন মহাবিশ্বের গঠন ও উপাদান নিয়ে গবেষণা করেন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে: মহাবিশ্বের মূল রাসায়নিক উপাদান কোথা থেকে এলো? আজ আমরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ ও আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম (interstellar medium)-এ যে উপাদানগুলো দেখতে পাই, তার ভিত্তিতে বোঝা যায় যে বিগ ব্যাং-এর সময় ঠিক কী ঘটেছিল।

বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিস – আদিম পরমাণু সৃষ্টি

বিগ ব্যাং-এর পরে, মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত ও ঘন। এই অবস্থায় শুধুমাত্র মৌলিক কণা (protons, neutrons, and electrons) অস্তিত্বশীল ছিল। কিন্তু বিগ ব্যাং-এর প্রায় ১ থেকে ৩ মিনিট পর, মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে আসতে শুরু করে এবং প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হয়ে হালকা মৌলিক উপাদান গঠন করে।

এই পরমাণু সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে Big Bang Nucleosynthesis (BBN) বলা হয়। এই সময় প্রধানত তিনটি প্রধান মৌল গঠিত হয়:

  1. হাইড্রোজেন (Hydrogen – H)
  2. হিলিয়াম (Helium – He)
  3. লিথিয়াম (Lithium – Li) (সামান্য পরিমাণে)

এই মৌলিক উপাদানগুলোর অনুপাত মহাবিশ্বের প্রথম দিকের অবস্থা ও ঘনত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়


মহাবিশ্বের মৌলিক রাসায়নিক অনুপাত

আজ আমরা মহাবিশ্বে যে উপাদানগুলোর অনুপাত দেখি, তা আশ্চর্যজনকভাবে বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিসের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে যায়:

  • ৭৫% হাইড্রোজেন
  • ২৪% হিলিয়াম
  • ১% বা তার চেয়ে কম অন্যান্য মৌল (লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ইত্যাদি)

এই অনুপাত পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম কারণ নিউক্লিওসিন্থেসিস কেবলমাত্র বিগ ব্যাং-এর প্রথম কিছু মিনিটের মধ্যেই ঘটেছিল।


বিজ্ঞানীরা কীভাবে এই অনুপাত নির্ধারণ করলেন?

১. নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির বিশ্লেষণ:
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গ্যালাক্সির স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাণ একই রকম।

২. বিস্ফোরণধর্মী নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ:
সুপারনোভার সময় যে উপাদান নির্গত হয়, তা বিশ্লেষণ করেও বোঝা যায় যে মহাবিশ্বের শুরুতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের আধিপত্য ছিল।

৩. CMB বিকিরণের সাথে মিলিয়ে দেখা:
কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের বিশ্লেষণ আমাদের বলে দেয় যে, মহাবিশ্বের প্রথমদিকে পদার্থের ঘনত্ব ও বিস্তার কেমন ছিল। এর সঙ্গে রাসায়নিক অনুপাত মেলালে দেখা যায় যে BBN-এর গণনা পুরোপুরি সঠিক।


কেন এটি বিগ ব্যাং-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ?

১. এই অনুপাত কেবলমাত্র বিগ ব্যাং মডেল দ্বারাই ব্যাখ্যা করা সম্ভব:
অন্য কোনো মহাজাগতিক মডেল (যেমন স্থির অবস্থা তত্ত্ব – Steady State Theory) এই মৌলিক উপাদানের অনুপাত ব্যাখ্যা করতে পারে না।

২. এটি মহাবিশ্বের শুরুর সময়ের তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছে:
অন্যান্য মৌলিক উপাদান (যেমন কার্বন, অক্সিজেন) তারার অভ্যন্তরে তৈরি হয়, কিন্তু হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের প্রাথমিক অনুপাত পরিবর্তন হয়নি।

৩. মহাবিশ্বের প্রসারণের হার সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দেয়:
যদি আমরা এই মৌলগুলোর অনুপাত বিশ্লেষণ করি, তাহলে মহাবিশ্বের প্রাথমিক ঘনত্ব ও প্রসারণের হার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।


মহাবিশ্বের প্রসারণ – হাবল আইন ও রেডশিফট

আমরা জানি যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং বলি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে মহাবিশ্ব আসলেই প্রসারিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে হাবল আইন (Hubble’s Law) ও রেডশিফট (Redshift)-এর মধ্যে।


১. হাবল-এর পর্যবেক্ষণ: গ্যালাক্সিগুলোর দূরে সরে যাওয়া

১৯২০-এর দশকে, আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল (Edwin Hubble) একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখতে পান যে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং যত দূরের গ্যালাক্সি, তত বেশি গতিতে দূরে যাচ্ছে।

এই পর্যবেক্ষণ তিনি স্পেকট্রোস্কোপি (spectroscopy) ব্যবহার করে করেছিলেন। বিভিন্ন গ্যালাক্সির আলোর বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেন যে প্রায় সব গ্যালাক্সির আলোক তরঙ্গদৈর্ঘ্য লম্বা হয়ে যাচ্ছে—অর্থাৎ, তারা লাল দিকে সরে যাচ্ছে।

এই ঘটনাকে বলা হয় রেডশিফট (Redshift), যা বুঝায় যে সেই গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।


২. রেডশিফট কীভাবে কাজ করে?

রেডশিফট একটি ডপলার প্রভাবের (Doppler Effect) ফলাফল। এই একই প্রভাব আমরা দৈনন্দিন জীবনেও অনুভব করি:

  • যখন একটি অ্যাম্বুলেন্স আমাদের দিকে আসে, তখন এর সাইরেনের শব্দ বেশি উচ্চস্বরে শোনায়।
  • যখন এটি দূরে সরে যায়, তখন শব্দ কম কম্পাঙ্কের হয়ে যায় এবং বেশি ভারী শোনায়।

এটি ঘটে কারণ শব্দের তরঙ্গ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়, যা এর কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করে।

আলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

  • যদি একটি গ্যালাক্সি আমাদের দিকে আসে, তবে এর আলো নীলশিফট (Blueshift) হয়ে যায় (আলোর তরঙ্গ সংকুচিত হয়)।
  • যদি একটি গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তবে এর আলো রেডশিফট (Redshift) হয়ে যায় (আলোর তরঙ্গ প্রসারিত হয়)।

হাবল দেখলেন যে প্রায় সব গ্যালাক্সির আলোই রেডশিফট হয়েছে, যার মানে তারা আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।


৩. হাবল আইন (Hubble’s Law): গতি ও দূরত্বের সম্পর্ক

হাবল কেবল রেডশিফটই আবিষ্কার করেননি, বরং তিনি দেখান যে একটি গ্যালাক্সির আমাদের থেকে দূরত্ব যত বেশি, সেটি তত বেশি গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে।

তিনি একটি সরল গাণিতিক সমীকরণ আবিষ্কার করেন, যা এখন হাবল আইন নামে পরিচিত:


v = H0 × d

এখানে,

  • v = গ্যালাক্সির সরে যাওয়ার গতি (কিলোমিটার/সেকেন্ড)
  • H0 = হাবল ধ্রুবক (Hubble Constant), যার মান আজকের গণনায় প্রায় ৭০ কিমি/সেকেন্ড/মেগাপারসেক
  • d = গ্যালাক্সির আমাদের থেকে দূরত্ব (মেগাপারসেক – Mpc, যেখানে ১ Mpc ≈ ৩.২৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষ)

এই সমীকরণ বলে দেয় যে গ্যালাক্সি যত দূরে থাকবে, তার গতিও তত বেশি হবে!


৪. মহাবিশ্বের প্রসারণ ও বিগ ব্যাং-এর প্রমাণ

হাবল আইন থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মহাবিশ্ব স্থির নয়, বরং ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। যদি আমরা সময়কে উল্টে দিই, তাহলে দেখা যাবে যে সব গ্যালাক্সি একসময় কাছাকাছি ছিল এবং এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল!

এটি বিগ ব্যাং তত্ত্বের (Big Bang Theory) জন্য অন্যতম শক্তিশালী প্রমাণ।

  • যদি গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যেতে পারে, তবে অতীতে তারা কাছাকাছি ছিল।
  • প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে, তারা একেবারে একটি বিন্দুতে ছিল, যেখান থেকে মহাবিশ্বের বিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল।

৫. প্রসারণ কি অনন্তকাল ধরে চলবে?

বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে মহাবিশ্ব অবিরত প্রসারিত হবে, নাকি একসময় আবার সংকুচিত হয়ে যাবে। সম্ভাব্য তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে:

  1. Big Freeze (অনন্ত প্রসারণ) – যদি মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি কমে না আসে, তবে এটি চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে, এবং একসময় সমস্ত নক্ষত্র নিভে যাবে, মহাবিশ্ব শীতল ও অন্ধকার হবে।
  2. Big Crunch (সংকোচন) – যদি মহাবিশ্বের ভর অনেক বেশি হয়, তবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একসময় প্রসারণকে থামিয়ে দেবে এবং পুরো মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়ে আবার একটি বিন্দুতে ফিরে আসবে।
  3. Big Rip (পূর্ণ ধ্বংস) – যদি ডার্ক এনার্জি নামে এক অজানা শক্তি খুব বেশি শক্তিশালী হয়, তবে একসময় এটি মহাবিশ্বের সমস্ত গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ এমনকি পরমাণুকেও আলাদা করে দেবে!

বর্তমানে, Big Freeze তত্ত্বই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য, কারণ মহাবিশ্বের প্রসারণ ক্রমাগত দ্রুততর হচ্ছে।


কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) – মহাবিশ্বের প্রাচীনতম আলো

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি যে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এক মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং (Big Bang) বলি। কিন্তু এই বিস্ফোরণের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ কী আছে?

বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন—এটি হলো কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB)। এটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরনো আলো, যা আজও আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে!


১. মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থা: প্লাজমা ও ফোটন ফাঁদ

মহাবিশ্ব যখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড পুরোনো, তখন এটি ছিল অত্যন্ত গরম ও ঘন। সবকিছু ছিল প্লাজমার আকারে—অর্থাৎ, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনগুলো এত বেশি শক্তিশালী ছিল যে তারা পরমাণু গঠন করতে পারেনি।

এই সময় ফোটন (আলো কণা) ছিল সব জায়গায়, কিন্তু তারা ইলেকট্রনগুলোর সঙ্গে বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। ফলে কোনো আলো মুক্তভাবে ভ্রমণ করতে পারছিল না, মহাবিশ্ব ছিল সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ (opaque)।


২. ৩৮০,০০০ বছর পর – প্রথম আলো মুক্তি পেল

মহাবিশ্ব যখন প্রায় ৩৮০,০০০ বছর বয়সী হলো, তখন এটি ঠান্ডা হতে শুরু করল। তাপমাত্রা ৩০০০ কেলভিনের নিচে নেমে এলো, এবং ইলেকট্রন ও প্রোটন একত্রিত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু গঠন করল

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ—

  • ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর অংশ হয়ে যাওয়ায়, ফোটনগুলো বাধাহীনভাবে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারল।
  • এই প্রথমবার মহাবিশ্ব পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়ে গেল।

এই মুক্ত আলোই আজ আমরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (CMB) নামে দেখতে পাই।


৩. CMB-এর আবিষ্কার: কিভাবে প্রথম ধরা পড়ল?

CMB-এর প্রথম তাত্ত্বিক ধারণা দেন বিজ্ঞানীরা রাল্ফ আলফার, রবার্ট হারম্যান ও জর্জ গ্যামো ১৯৪৮ সালে। কিন্তু তখন এটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

১৯৬৪ সালে, দুই মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস (Arno Penzias) এবং রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) এটিকে ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করেন!

  • তাঁরা একটি বিশেষ অ্যান্টেনার সাহায্যে রেডিও তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
  • কিন্তু তারা সব সময় একধরনের আলগা গুঞ্জন (static noise) শুনতে পাচ্ছিলেন, যা কোথাও থেকে আসছে।
  • অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, তারা বুঝতে পারেন যে এটি আসলে মহাবিশ্বের সব জায়গা থেকে আসছে এবং এর কোনো নির্দিষ্ট উৎস নেই!
  • পরে বোঝা যায় যে এটি আসলে CMB, যা বিগ ব্যাং-এর সরাসরি প্রমাণ!

এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে তারা নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।


৪. CMB-এর বৈশিষ্ট্য ও মানচিত্র

CMB-এর তাপমাত্রা বর্তমানে প্রায় ২.৭৩৫ কেলভিন (অত্যন্ত শীতল!) এবং এটি মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অবস্থিত।

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মহাকাশযান ব্যবহার করে CMB-এর বিশদ মানচিত্র তৈরি করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো:

  • COBE (1990-এর দশক) – প্রথমবার CMB-এর সূক্ষ্ম পরিবর্তন (fluctuation) শনাক্ত করে।
  • WMAP (২০০১-২০১০) – মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট বয়স ও গঠন সম্পর্কে তথ্য দেয়।
  • Planck (২০০৯-বর্তমান) – এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভুল CMB মানচিত্র তৈরি করেছে।

CMB-এর মানচিত্রে ছোট ছোট উষ্ণ ও শীতল অঞ্চল দেখা যায়। এই অঞ্চলগুলিই পরবর্তী সময়ে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহের জন্মের ভিত্তি তৈরি করেছে!


৫. CMB কেন গুরুত্বপূর্ণ?

CMB হল মহাবিশ্বের জন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। এটি আমাদের বলে:

  • মহাবিশ্ব সত্যিই বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল
  • মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর
  • গ্যালাক্সির গঠন কিভাবে হয়েছিল।
  • মহাবিশ্ব কীভাবে প্রসারিত হচ্ছে।

এটি এমন একটি আবিষ্কার, যা পুরো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানকেই বদলে দিয়েছে!

80 Views
No Comments
Share
1
No comments to “বিগ ব্যাং তত্ত্বের বাস্তব প্রমাণ”