খ্রিস্টান ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাতের ধারণাটি মূলত ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কারণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে এটি একটি সরলীকৃত ব্যাখ্যা, কারণ বাস্তবে খ্রিস্টান ধর্ম ও বিজ্ঞান কখনো পুরোপুরি পরস্পরের বিরোধী ছিল না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে। তবুও, সংঘাতের কিছু প্রধান কারণ ও সমালোচনা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. গ্যালিলিও ও চার্চের দ্বন্দ্ব
গ্যালিলিও গ্যালিলেই যখন সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণাকে সমর্থন করেন, তখন ক্যাথলিক চার্চ এটিকে বাইবেলের বিরোধী বলে ঘোষণা দেয়। চার্চের বিরুদ্ধে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গ্যালিলিওকে গৃহবন্দি হতে হয়। এই ঘটনা ধর্মীয় কর্তৃত্ব বনাম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মধ্যে সংঘাতের প্রতীক হয়ে ওঠে।
২. উৎপত্তিতত্ত্ব ও ডারউইনবাদ
চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনভিত্তিক বিবর্তন তত্ত্ব বাইবেলের সৃষ্টি বর্ণনার বিরোধী বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে যেসব খ্রিস্টান সৃষ্টিতত্ত্বকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেন, তারা বিবর্তনবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও আধুনিক খ্রিস্টান চিন্তাবিদদের অনেকেই বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন, তবুও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের জায়গা হয়ে রয়েছে।
৩. বিজ্ঞান ও অলৌকিক বিশ্বাস
ধর্ম সাধারণত অলৌকিক ঘটনাকে স্বীকার করে, যা বিজ্ঞান অনুসারে পরীক্ষাযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, মৃত থেকে পুনরুত্থান, কুমারী মাতা মারিয়া থেকে যীশুর জন্ম ইত্যাদি ঘটনাগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ফলে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য দেখা যায়।
৪. ধর্মীয় নৈতিকতা বনাম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান
ক্লোনিং, স্টেম সেল রিসার্চ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও খ্রিস্টান ধর্ম ও বিজ্ঞান মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। চার্চ অনেক সময় জীবনের পবিত্রতার যুক্তিতে কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যা গবেষণার স্বাধীনতাকে সীমিত করে।
সমালোচনা ও পর্যালোচনা
বিজ্ঞান ও খ্রিস্টান ধর্মের সংঘাত নিয়ে সমালোচনার দুটি দিক রয়েছে।
১. ধর্মবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি
অনেক বিজ্ঞানপন্থী মনে করেন যে ধর্মের ধ্যান-ধারণা মধ্যযুগে বিজ্ঞানচর্চার অন্তরায় ছিল এবং আজও কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষত, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি আধুনিক জ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
২. সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি
অনেকে মনে করেন, ধর্ম ও বিজ্ঞান একে অপরের সম্পূরক। খ্রিস্টান ধর্মের অনেক বিজ্ঞানী (যেমন: গ্রেগর মেন্ডেল, কোপার্নিকাস, লেমেত্র) বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এমনকি পোপ ফ্রান্সিসও বিবর্তন ও বিগ ব্যাং তত্ত্বকে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয় বলে মত দিয়েছেন।
অতএব, খ্রিস্টান ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত একমাত্রিক কোনো বিষয় নয়; বরং এটি ইতিহাস, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল। দুটির মধ্যে সংঘাত থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তারা একে অপরকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করেছে।
